Select a date and time slot to book an Appointment
Date Of Appointment
বাবা যখন নতুন মাকে নিয়ে প্রথমবার বাসায় আসলেন, আমি নিজে দরজা খুলে হাসিমুখে মাকে স্বাগতম করেছিলাম। লাল শাড়ি আর অনেক গয়নায় মাকে কি যে সুন্দর লাগছিল ! কিন্তু কেন যেন উনি আমাকে দেখে মুখ কালো করে ঘরে চলে গেলেন। বাবাও তার পিছু পিছু ছুটলো ... আমার কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা দরজা লাগিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। বাবা দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বললেন,
- তিয়াশা ও আমার মেয়ে, আমি কি করে ওকে অন্য কোথায় রেখে আসি বলো তো?
-(ওপাশ থেকে রাগী রাগী গলায়) আমাদের বিয়ের আগে এটাই ঠিক হয়েছিল, আমি তোমার সাথে সংসার করব, কিন্তু তোমার মেয়েকে আগে অন্য কোথাও রেখে আসতে হবে !
বাবা করুণ দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকালেন। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে বললেন,
- আচ্ছা এটা নিয়ে পরে আলোচনা করি? ভেতরে আসতে দাও। দরজা খোলো। কথা বলে কোন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে...
খটাস করে দরজার খিল খোলার শব্দ পেলাম। বাইরে ঝড় হচ্ছে তাই কারেন্ট চলে গেছে। বারবার ঠাডা পড়ার শব্দ আসছে, সেই সাথে আসছে আলো। জানালা থেকে বিদ্যুতের আলো এসে পড়ছে মায়ের মুখে। তিনি কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করার শক্তি এই পৃথিবীতে কারো নেই। বাবা তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কাল সকালের আগে এই দরজা খুলবেনা। আমার হাত থেকে টেডি বিয়ারটা কখন যে মেঝেতে পড়ে গেছে খেয়ালই করিনি। যেন ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। সেদিন মাত্র সাত বছর বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম, বাবার পরিবারে এখন আমার স্থান আগাছার মত...শুধুই আগাছা...
.
আমার জন্মের দুই বছর পরে আমার মা আবার কনসিভ করেন। প্রেগনেন্সিতে কিছু কমপ্লিকেশন থাকায় মা আর আমার সদ্য জন্ম নেওয়া ছোট ভাই সেদিনই মারা যান। এরপর একটা দীর্ঘ সময় বাবা একা কাটিয়েছেন। আমার আর বাবার সম্পর্ক অদ্ভুত। বাবা রোজ অফিস থেকে এসে আমার সাথে খেলেন। ক্লান্ত শরীরে খাবার রান্না করেন, নিজে খান আর আমাকেও খাওয়ান৷ বাবা হয়ত কখনো ভাবেন নি তিনি আবার বিয়ে করবেন৷ গতবার জন্মদিনে আমিই জেদ করে বসেছি, আমার নতুন মা লাগবে৷ বাবা হয়ত ভেবেছেন আমি মায়ের অভাব খুব বোধ করি৷ উঁহু! আসলে মোটেও তা না! বাবাই তো আমার সব ....কিন্তু আমি আমার বাবার জন্য স্ত্রীর অভাব খুব করে বোধ করি...
.
পরদিন সকালে রোজকার মত বাবা আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে খাইয়ে দিলেন, স্কুলের জন্য রেডি করলেন। মা তখনও ঘুম থেকে উঠেনি। স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হতেই, মা ভেতর থেকে চিৎকার করতে শুরু করল। আমি আর বাবা ভেতরে গিয়ে দেখি, প্লেট গ্লাস ভেঙে অবস্থা খারাপ অবস্থা করে রেখেছে...
বাবা অসহায়ের মত মাকে বললেন,
-এসব কি করেছ !
মা বললেন,
-তুমি এতদিন ধরে আমাকে চেনো, তুমি জানো না আমি ডিম খাই না! তাও কেন করলে?
-আসলে আমার খেয়াল ছিল না৷ তানিয়ার (আমি) ডিম খুব পছন্দ তাই করেছি।
- (চিৎকার করতে করতে) এখন কি সব রান্না এই মেয়ের পছন্দ অনুযায়ী হবে আর আমাকে সেটা খেতে হবে? আমার পছন্দ অপছন্দ বলতে কিছু নেই? এইজন্য তুমি আমাকে বিয়ে করে এনেছ?
বাবা আমতা আমতা করছেন। কিছুই বলতে পারছেনা। আমি তার অসহায় চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আছি। সে এসব অশান্তি দেখে অভ্যস্ত না। শুনেছি আমার মা নাকি খুব শান্ত ছিল... বাবা সেরকম একজনকে কেন বেছে নিলেন না?
.
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। সেরকম কোন সমস্যাই হয়না, শুধু মাঝে মাঝে মা দুপুরে আমার জন্য খাবার রাখতে ভুলে যান৷ স্কুল থেকে এলে খুব খিদে লাগে...কিন্তু...ভুল তো মানুষেরই হতে পারে। বাবাকে কখনো কিছু বলিনা৷ কেন যেন বলতে ইচ্ছে করেনা...হয়ত আমিও আমার আগের মায়ের মতই হয়েছি। নতুন মা একবার আমাকে খুব মারলেন, আমি নাকি তার জুয়েলারি ভেঙে ফেলেছি। কিন্তু আমি কিছুই করিনি। অনেকদিন ব্যাথা ছিল হাতে৷ কিন্তু বাবা কিছু বুঝতে পারেন নি৷ তার আর আমার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। মা রোজ আমাকে নিয়ে ঝগড়া করত বাবার সাথে। বাবাকে একদিন কি ভেবে যেন বললাম,
- আমাকে নানুবাড়িতে রেখে এলেই তো পারো বাবা।
বাবা বললেন,
-মারে, তোকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব বল তো?
আমার চোখে পানি চলে আসলো। বাবাকে সজোরে জড়িয়ে ধরলাম। মনে হচ্ছিল, এই মানুষটার জন্য হাজার খানেক মার আমি অনায়াসে সহ্য করতে পারব...যেন কিছুই মনে হবেনা...
.
সময় চলছিল তার নিজ গতিতে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেল। সাত আটমাস হবে বাবার বিয়ের। মা এর মধ্যে কনসিভ করলো। এরপর বাবা এলাহি কান্ড করে ফেললেন। পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে মিষ্টির প্যাকেট দিলেন। বাসায় একটা ফুল টাইম কাজের মেয়ে রাখলেন। আমিও ভীষণ খুশি।
কিন্তু আমার প্রতি মায়ের বিদ্বেষ দিন দিন বাড়তেই লাগলো। এর আরও একটা কারণ ছিল, কাজের মেয়ে আমার নামে মাকে উল্টাপাল্টা বোঝাত যে, আমি নাকি আর কোন ভাইবোন চাইনা, আমি তার বাচ্চার ক্ষতি করব। তাই আমাকে আশেপাশে দেখলেই তিনি রেগে যেতেন। একবার আমাকে দেখে রেগে গিয়ে ফুলদানি ছুড়ে মারলেন। মাথার একসাইডে লেগে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো৷ তারপর থেকে আমি আর তার সামনে যাই না৷ নিজেরই বাড়িতে কেমন যেন লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়...
একদিন সকালে কাজের মেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা পানি মুছতে ভুলে গেল। সাদা টাইলসের জন্য পানি বোঝা যাচ্ছিল না। মা কেন যেন ওদিক দিয়ে হেঁটে ডাইনিং রুমে যাচ্ছিল। তখন মায়ের দুই মাস চলে। মেঝেতে পড়ে থাকা পানিতে মা পিছলে পড়ে গিয়ে গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগলেন। রান্নাঘর থেকে কাজের মেয়ে, পাশের রুম থেকে আমি ছুটে আসলাম। বাবাকে খবর দিলাম৷ উনি এসে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। এই ফাঁকে কাজের মেয়ে কখন যেন মাকে বলেছেন, পানিটা আমি ফেলে রেখেছি তাও আবার ইচ্ছাকৃত। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও কাজ হয়নি। বাবুটাকে বাঁচানো যায়নি। মা এবার কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বললেন,
-এই মেয়েকে তুমি কোথাও রেখে আসো প্লিজ! এ থাকতে আমার বাচ্চা এই পৃথিবীর মুখ দেখতে পারবে না...
সেদিন বাবা আর কোন কথা না বলে আমাকে হাসপাতাল থেকে সরাসরি নানুবাড়িতে রেখে আসলেন। আমি তার ভাবলেশহীন চোখ দেখে তাকিয়ে ছিলাম। সেই চোখে আমার জন্য কোন ভালোবাসা, আবেগ নেই। সেদিন তৃতীয় একজন মানুষের জেদ আর ঘৃণার কাছে হেরে গেল বাবা-মেয়ের ভালোবাসা...কোথায় গেল আমার সেই নরম, সহজ মনের বাবা? মনে হচ্ছিল এই মানুষটা যেন আমার বাবা নন, অন্য কেউ !
.
(১০ বছর পর)
আজ এতবছর পর সবকিছু যেন আবার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমার সামনে তিনজন বসে আছেন। আমার বাবা আর নতুন মা, আরেকজন আমার নানিমা। বাবার অনেকগুলো চুল পেকে গেছে, কেমন যেন দূর্বল লাগছে তাকে। মায়ের চামড়া কুচকে গেছে, বয়সের ছাপ স্পষ্ট। শুনেছি গত দশ বছরে মায়ের ৫ টা মিসক্যারেজ হয়েছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন যে তিনি আর মা হতে পারবেন না। তাই তারা আজ আমার কাছে এসেছেন আমাকে ফিরিয়ে নিতে। আমাকে তাদের সন্তানের মত বুকে টেনে নিতে চান আবার। নানি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি যেতে চাই কি না। আমি কিছুই বলিনি। শুধু চোখ বন্ধ করেছি আর অতীতের সবকিছু সামনে ভেসে এসেছে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে নিজের অজান্তেই। আশ্চর্য! এত কষ্ট ছিল আমার মনে? অথচ আমি ভাবতাম আমি সব ভুলে গেছি...
চোখ মুছে নানির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি কোথাও যাব না। ওনাদের ফিরে যেতে বলো।
একথা বলেই ঘরে চলে আসছি..পেছন ফিরে তাকাই নি একবারও। অথচ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম মা কান্না কান্না কণ্ঠে নানিকে বললেন,
ওকে প্লিজ আমাদের সাথে যেতে বলেন। আমি জানি আমি অন্যায় করেছি কিন্তু আমি তো ক্ষমা চাচ্ছি...আমি আজীবন নিঃসন্তান হয়ে থাকতে চাইনা।
কিন্তু বাবা কিছুই বলছেন না। কিছুই তো বলার নেই তার...কিছুই না...
ঘরে এসে জানালার কাছে দাঁড়ালাম। নিচতলায় মা বাবার গাড়ি দেখা যাচ্ছে৷ ওরা সেটার কাছে যাচ্ছেন।
আজ কেন যেন বাবাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে,
খুব মিস করি তোমার সাথে হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, তোমার হাতে খাবার খাওয়া, তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা...সব ভীষণ মনে পড়ে আমার!
ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজে গেল। সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কিন্তু এই ঝাপসার মধ্যেও কেন যেন মনে হলো বাবা আমার দিকে একবার ফিরে তাকালেন। বাবার চোখ এবার আবেগহীন না, ছলছল করছে পানিতে। কিন্তু এসব খুব অবাস্তব লাগে এখন...হয়ত আমারই চোখের ভুল। জীবনে কিছু কিছু অধ্যায়ের ইতি টানাই ভালো। বাবার সেই ছলছল চোখ এড়ানোর জন্য জানালার পর্দা টেনে দিলাম...এই পর্দা আর কখনো তাকে দেখার জন্য খোলা হবেনা...কখনোই না।
View more on Facebook
We appreciate you contacting us. Our support will get back in touch with you soon!
Have a great day!
Please note that your query will be processed only if we find it relevant. Rest all requests will be ignored. If you need help with the website, please login to your dashboard and connect to support